রবিবার, ১৯শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

দালালের ভারে ডুবছে যশোর জেনারেল হাসপাতাল

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে দালালের দৌরাত্ম্য দীর্ঘদিন থেকেই। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ওষুধ ফার্মেসীর অর্ধশত দালাল সরকারি এই হাসপাতালে অবস্থান নিয়ে জমপেশ প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। অধিকাংশ দালাল হাসপাতালের আশেপাশের এলাকার হওয়ায় প্রভাবের সাথে প্রতারণা কর্মকান্ড করে থাকে। ২টি সিন্ডিকেটে অর্ধশতাধিক দালাল হাসপাতালের রোগী ও স্বজনদের কাছে নেতিবাচক নানা কথা বলে তাদের ভাগানোর কাজ করেন। এখানকার চিকিৎসাসেবা ও প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পর্কে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত ও দুর্বল করে তোলে।

সূত্র জানায়, এসব দালালের সাথে হাসপাতালের কতিপয় চিকিৎসক ও কর্মচারীর সুসম্পর্ক রয়েছে। হাসপাতাল থেকে তাদের হাতে রোগী তুলে দিলে তারা নির্দিষ্ট পরিমাণে কমিশন পান। সূত্রটি আরো জানায়, দালালদের অধিকাংশরা রাজনৈতিক পরিচয়ে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে। কোন না কোন নেতার সাথে তাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। ওই সব দালালদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মিছিল মিটিংয়েও দেখা যায়।

অভিযোগ উঠেছে, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ওষুধ ফার্মেসীর নিয়োগকৃত দালালরা পুলিশের সহায়তায় ফাঁদ পেতে প্রতারণা জোরদার করে। রোগী ভাগিয়ে নিয়ে তারা কমিশনে বিক্রি করছে। আবার ৩শ টাকার ওষুধ অনেক সময় দাম হয়ে যায় ৩ হাজার টাকা। রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে রেখে দেয়া স্লিপে দালালরা ইচ্ছামতো দামি ওষুধের নাম লিখে অর্থ হাতিয়ে নেয়। এমনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন যশোর সদরের ওসমানপুর গ্রামের আমিরুল ইসলাম নামে এক রোগীর স্বজন। দালালের খপ্পরে পড়ে আমিরুলের ১২শ ৭০ টাকা বাড়তি গুনতে হয়েছে। আমিরুলের মতো অনেকেই প্রতিদিন ফার্মেসী দালালের কবলে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন। দালালী করে আয় করা অর্থের ভাগ পাচ্ছে হাসপাতালে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দালাল জানান, দালালদের কাছ থেকে পুলিশ শতকরা ২০ টাকা করে নেয় । টাকা না দিলে পুলিশ তাদের নানা ভাবে ঝামেলা করে। জরুরি বিভাগে দাঁড়ানোর সুযোগও দেয়া হয়না।

জানা গেছে, সরকারি এই হাসপাতালকে ঘিরে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে অর্ধশতাধিক ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। দালালদের কেউ কেউ কোনো কোনো ক্লিনিকের মালিক বনে গেছেন। আবার কারও কারও অংশীদারি আছে বিভিন্ন ক্লিনিকে। দালালদের সহযোগিতা নিয়েই ওই এলাকায় কতিপয় প্রভাবশালী হাসপাতাল ব্যবসা চালিয়ে আসছে। মূলত সরকারি হাসপাতাল থেকে ভাগিয়ে নেয়া রোগীই তাদের হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে যাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ দালালের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরছেন। হাসপাতালের মূল ফটক থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত গোটা হাসপাতালে দালালের অবাধ বিচরণ। স্বেচ্ছাসেবক নাম দিয়ে প্রকাশ্যে দালালি করারও সুযোগ দেওয়া হয়েছে কয়েকজনকে। দালালের কেউ কেউ বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদদাতার পরিচয়পত্র সঙ্গে রেখে সার্বক্ষণিক হাসপাতালে অবস্থান করে। রোগীদের হাসপাতাল থেকে নিয়ে যায় বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। প্রতিবাদ করলে ওই দালালেরা সংবাদপত্রে মিথ্যা প্রতিবেদন ছাপানোর হুমকি দেয়। ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান নিয়মিত পরিচালনা ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হলে দালালরা প্রকাশ্যে প্রতারণা করার সাহস দেখাতো না।যশোর সদর উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নের চান্দুটিয়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম জানান, সোমবার (১০ জুন) তিনি স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাবেন বলে জেনারেল হাসপাতালে আসেন। কাউন্টার থেকে টিকিট কাটার পর হাত কাটা এক ব্যক্তি তাকে বলেন ‘ভাই প্রচন্ড ভিড় ডাক্তার দেখাকে কষ্ট হবে। হাসপাতালের বর্হিঃবিভাগের একটি স্পেশাল কক্ষ আছে চলেন সেখান থেকে ডাক্তার দেখিয়ে দেবো। ভুল বুঝিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় কমটের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। ডাক্তার দেখানোর নাম করে তার কাছে ৩০০ টাকা ফিস চাওয়া হয়। সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে ফিস কেনো লাগবে এমন প্রশ্নে দালাল রাগন্বিত হয়। রফিকুল ইসলাম আরও জানান, দালালের খপ্পরে পড়েছেন বুঝতে পেরে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে কমটেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে বের হয়ে আসেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে রফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রীকে কমটেকে ভাগিয়ে নেয়া দালালের নাম হাতকাটা আসাদ। তিনি কমটেকের পোষ্য দালাল। সকাল ৮ টা থেকে তিনি রোগী ভাগানোর কাজে হাসপাতালে অবস্থান করেন।

এনায়েতপুর গ্রামের আমির আলী জানান, মঙ্গলবার (১১ জুন) সরকারি এই হাসপাতালে বহিঃবিভাগে ডাক্তার দেখানোর জন্য এসেছিলেন। টিকিট কাউন্টার থেকে ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটার পর তিনি এক দালালের কবলে পড়েন। ওই দালাল তার রোগের কথা শুনে বলেন এখানে ডাক্তার ভালো করে দেখবেন না। সামান্য টাকার জন্য কেনো সরকারি এই হাসপাতালে রোগী দেখাবেন। আমার সাথে চলেন তিনশ টাকা ফি দিয়ে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে দেবো। সরল মনে তিনি ওই দালালের সাথে হাসপাতালের গা ঘেষে একটি ক্লিনিকে যান। সেখানে ডাক্তার দেখানোর পর বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা নিরীক্ষা করানো হয়েছে। চিকিৎসকের ফি ও পরীক্ষা বাবদ ২২শ ৫০ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে তার কাছ থেকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন চিকিৎসক জানান, অর্থোপেডিকের কয়েকজন চিকিৎসক সরাসরি দালালীতে নেমেছে। তারা ওয়ার্ড রাউন্ডে এসে রোগীদের বিভিন্ন কথা বলে আতংকগ্রস্থ করে ক্লিনিকে ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যে রোগী যেতে রাজি না হয় নানা অজুহাতে তার দীর্ঘদিনেও সরকারি হাসপাতালে অপারেশন করা হয়না। আবার বর্হিবিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসকের কক্ষের সামনে দায়িত্বরত একাধিক কর্মচারী রোগী ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকে পাঠিয়ে দেন পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য। বিনিময়ে তারা কমিশনের টাকা পান।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ জানান, এখানে যোগদানের পর দালালমুক্ত হাসপাতাল গড়তে নানা চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। পেশাদার দালালদের একটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এই তালিকা জেলা প্রশাসকের কাছে দেয়া হবে।

দেশ জার্নাল বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো মন্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো।

----- সংশ্লিষ্ট সংবাদ -----