সংবাদের আলো ডেস্ক: রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী সড়কের ভিকারুন্নেছা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ঠিক উল্টো পাশেই অবস্থিত রূপায়ণ স্বপ্ন নিলয় ভবন। গেল বছর এখানেই ৮৫ কাঠার ওপর নির্মিত চারটি ভবনের একটি সুবিশাল ফ্ল্যাট কেনেন রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রথম সচিব (কর) কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল। জানা গেছে, তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটটির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ছয় কোটি টাকা। যদিও এনবিআর এই কর্মকর্তা, ফ্ল্যাট কেনার সময় নিবন্ধন নিয়েছেন শ্বশুর আহম্মেদ আলীর নামে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রথম সচিব আবু মাহমুদ ফয়সালের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এবার এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এনবিআর সচিব ফয়সালের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। যদিও সংস্থাটির অনুসন্ধান এবারই প্রথম নয়। ২০২২ সাল থেকে দুদক অনুসন্ধান করছে ফয়সালের বিরুদ্ধে। তবে বর্তমান অনুসন্ধানে তাঁর ও তাঁর স্ত্রী আফসানা জেসমিন, শ্বশুর আহম্মেদ আলী ও শাশুড়ি মমতাজ বেগমসহ আত্মীয়স্বজনের নামে স্থাবর-অস্থাবরসহ ১৯ কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুদক। এদিকে, সম্প্রতি নতুন করে আরেকটি নথিযুক্ত করে একসঙ্গে অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়েছেন দুদকের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজ।
গত বৃহস্পতিবার তার আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত ফয়সাল ও তার স্ত্রীসহ আত্মীয়দের নামে থাকা প্রায় ১৭ কোটি টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ জব্দের আদেশ দেন। একই সঙ্গে ৮৭টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশও দেয়া হয় এদিন। দুদক সূত্রে জানা যায়, এনবিআর সচিব ফয়সালের এত সম্পদের নেপথ্যে রয়েছে রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য। ১৯ বছরের চাকরি জীবনে ঘুষ লেনদেনসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ফয়সাল। অনুসন্ধানে নেমেই ফয়সাল ও তার স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়িসহ স্বজনদের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও ব্যাংকে অর্থের তথ্য পেয়েছে দুদক।
দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ফয়সালের শ্বশুর আহম্মেদ আলীর নামে থাকা সিদ্ধেশ্বরী সড়কে তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট। জানা যায়, এই ফ্ল্যাটটি গত বছরের অক্টোবর মাসে কেনেন কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল। তবে নিবন্ধন শ্বশুরের নামে থাকলেও বাস করেন তিনি ও তার পরিবার। এদিকে ফয়সালের সম্পদের বিবরণী বৃহস্পতিবার ঢাকার আদালতের কাছে তুলে ধরেছে দুদক। আদালতে জমা দেয়া দুদকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের জুনে রাজধানীর ভাটারা এলাকায় ফয়সালের নামে পাঁচ কাঠার একটি প্লট কেনা হয়।
এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তার নামে আলাদা চারটি দলিলে জমি কেনা হয়। এসব সম্পদের দলিল মূল্য দেখানো হয় ৪০ লাখ টাকার বেশি। ফয়সালের শ্বশুর আহমেদ আলীর নামে রাজধানীর রমনা এলাকায় গত বছর অক্টোবরে একটি ফ্ল্যাট কেনা হয়, যার মূল্য দেখানো হয় ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া শাশুড়ি মমতাজ বেগমের নামে ২০২২ সালে খিলগাঁওয়ে ১০ কাঠার একটি প্লট কেনা হয়। দলিল মূল্য ৫২ লাখ টাকা। গত বছর রাজধানীর ভাটারা এলাকায় ফয়সালের স্ত্রী আফসানা জেসমিনের নামে কেনা হয় পাঁচ কাঠার প্লট।
প্লট কেনার অর্থ (৭৫ লাখ টাকা) পরিশোধ করা হয়েছে মাহমুদা হাসানের নামে থাকা একটি ব্যাংক হিসাব থেকে। এর চার বছর আগে স্ত্রীর নামে একই এলাকায় আরো পাঁচ কাঠার একটি প্লট কেনা হয়। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জেও স্ত্রীর নামে জমি রয়েছে। এসব সম্পদের দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে ৪২ লাখ টাকা। এছাড়াও ফয়সাল ও তার পরিবারের সদস্যের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব ও সঞ্চয়পত্রের বিবরণও আদালতে জমা দিয়েছে দুদক। এতে দেখা যায়, ফয়সাল, তার স্ত্রী ও শ্বশুরের নামে ৫০ লাখ টাকা করে সঞ্চয়পত্র রয়েছে। এর বাইরে তার স্বজনদের নামেও সঞ্চয়পত্র রয়েছে। দুদক বলেছে, তাদের নামে থাকা সঞ্চয়পত্রের মোট অর্থের পরিমাণ ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
ফয়সাল, তার স্ত্রী, শ্বশুর ও তার স্বজনদের ১৯টি ব্যাংক ও ১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা থাকা অর্থের পরিমাণ ৬ কোটি ৯৬ লাখ ৫০ হাজার ৯০৮ টাকা। দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতকে বলেছেন, করদাতাদের ভয়ভীতি ও বদলি-বাণিজ্যের শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে ফয়সালের বিরুদ্ধে। তাঁর ঘুষ ও দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধানে কাজ করছে দুদক। এদিকে আদালতের আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে, দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আদালতকে জানিয়েছেন, কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে বদলি বাণিজ্য ও আয়করদাতাদের ভয় দেখিয়ে অর্থ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এক হাজার কোটি টাকা অর্থ আত্মসাৎসহ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আছে। তার ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অপরাধলব্ধ আয়ের প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান, মালিকানা গোপন করে মানি লন্ডারিং অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মো: মোস্তাফিজ আদালতকে লিখিতভাবে জানান, এনবিআর কর্মকর্তা আবু মাহমুদ ফয়সাল সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ লেনদেন করেছেন। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত আয়ের উৎস গোপনের জন্য নিজের নামসহ তার আত্মীয়স্বজনের নামে ৭০০টির বেশি হিসাব খোলেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে, অপরাধলব্ধ আয়ের উৎস গোপন করা।