বুধবার, ২৩শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

‘আমি মনে হয় আর বাঁচব না মা, শেষবার একটু জল দাও’

সংবাদের আলো ডেস্ক: ‘দাদা, আমি তো শেষ। পুলিশ আমাকে গুলি করেছে। আমি সাভার বাসস্ট্যান্ডে রাস্তার ওপর পড়ে রইছি। অনেক কাকুতিমিনতি করছি, আমার কোনো কথা শোনেনি। বলছি আমি গার্মেন্টসে চাকরি করি। তা-ও আমার কলার ধরে রাস্তায় টেনে এনে পেটে বন্দুক ঠেকায়ে গুলি করেছে দাদা।’

গত ২০ জুলাই ঢাকার সাভারে সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর জ্ঞান হারানোর পূর্বমুহূর্তে বিকেল ৫টা ৫৫ মিনিটে মায়ের নম্বরে ফোন করেন তরুণ পোশাক শ্রমিক শুভ শীল (২৪)। বড় ভাই সোহাগ শীল সেই ফোন রিসিভ করলে এভাবেই নিজের অবস্থার কথা জানান তিনি। ওইদিন বিকেলে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন শুভ। সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩ জুলাই ভোরে তার মৃত্যু হয়। ঘটনার আগের দিন ধামরাইয়ে মামার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন শুভ। সেখান থেকে বাসায় ফেরার পথে সংঘাত-সহিসংতার মধ্যে পড়েন। মৃত্যুর পর দেশের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে যানবাহন না পেয়ে ঢাকাতেই সৎকার করা হয়েছে শুভকে। ধারদেনা করে চিকিৎসার জন্য প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ করলেও তাকে বাঁচানো যায়নি।

শুভর পরিবার জানায়, শুভ শীল আশুলিয়ার চক্রবর্তী এলাকার কেএসি ফ্যাশন লিমিটেডে সুইং অপারেটর পদে কর্মরত ছিলেন। বড় ভাই সোহাগ শীলও শুভর সঙ্গে ওই প্রতিষ্ঠানে কাটিং সেকশনে কর্মরত ছিলেন। ভাইয়ের সৎকারে পাঁচ দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় চাকরি হারিয়েছেন তিনি। করোনার সময় এসএসসি পাস করার পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে মা সাধনা শীল আর ভাইয়ের সঙ্গে শুভ নিজেও বছরখানেক আগে পোশাক কারখানায় যোগ দেন। তিনি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ঘোড়শাল ইউনিয়নের মুনুড়িয়া গ্রামের বিকাশ শীলের ছেলে। পরিবারের সঙ্গে আশুলিয়ার জিরানি বাজার এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। পরিবারের দুই ভাইয়ের মধ্যে শুভই ছিলেন ছোট। তার বাবা বিকাশ শীল জিরানি এলাকায় একটি সেলুনের দোকান চালান।

শুভর বড় ভাই সোহাগ শীল বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর শুভ রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থায় মায়ের নম্বরে ফোন দেয়। তখনো শুভর জ্ঞান ছিল। মায়ের ফোন তখন আমার কাছে। আমি ফোন রিসিভ করলে শুভ জানায়, গণ্ডগোলের মধ্যে সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আটকা পড়েছিল সে। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে একটি মার্কেটে আশ্রয় নেয়। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে মার্কেট থেকে বাইরে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলে এক পুলিশ সদস্য দেখে ফেলে। ওই পুলিশ কলার ধরে টেনে এনে রাস্তায় ফেলে শুভর পেটে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে। আমি তখন শুভকে বলি, যেভাবে পারিস আশপাশের লোকজনকে বলে হাসপাতালে যা, আমরা আসছি। এরপর শুভ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।’

ছেলের এমন মৃত্যুতে শুভ শীলের মা পোশাককর্মী সাধনা শীলের কান্না যেন থামছেই না। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন ২০ জুলাই রাত ৮টার দিকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছাই আমরা। গিয়ে দেখি আমার বাচ্চাটা বেডে পড়ে কাতরাচ্ছে। কাইন্দা কাইন্দা কয়, মা, আমি আর বাঁচব না। হাসপাতালের বেডে শুয়ে একটু জল চাইছিল বাচ্চাটা আমার কাছে। বলছিল, মা, আমাকে একটু জল দাও। খুব কষ্ট হচ্ছে মা আমার। শরীর অবশ হয়ে আসছে, আমি মনে হয় আর বাঁচব না, মা। শেষবার একটু জল দাও মা। আমি আমার বাচ্চাটার মুখে শেষবার এক ফোঁটা জলও দিতে পারিনি। ডাক্তারদের অনেক অনুরোধ করেছি। বোতল নিয়ে গেলেও ডাক্তাররা বলছিলেন অপারেশনের আগে জল দেওয়া যাবে না। সেই যে গেল অপারেশনের থিয়েটারে, আর আমার ছেলেটা ফিরল না। তিন দিন হাসপাতালে কত টাকা খরচ করলাম!’

তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো রাজনীতির মধ্যে নেই, আন্দোলনের মধ্যে নেই। কলার ধরে টেনে নিয়ে আমার ছেলেকে গুলি করেছে। আমার নিরপরাধ ছেলেটা পরিচয় দেওয়া সত্ত্বেও কেন আমার ছেলেকে গুলি করা হলো? কী দোষ ছিল আমার ছেলের? আমার ছেলের পেট ফুটো হয়ে গুলি ঢুকে আরেক দিক দিয়ে বের হয়ে গেছে, কী কষ্টটাই না হয়েছে আমার মানিকের! আমি আমার বুকের মানিকের হত্যার বিচার চাই।’

শুভ গত ১৯ জুলাই শুক্রবার দুপুর ১২টার পর জিরানির বাসা থেকে ধামরাইয়ের চৌঠাইল এলাকায় তার মামার বাসার উদ্দেশে রওনা হন। শুক্রবার রাতে মামার বাসাতেই ছিলেন শুভ। পরদিন ২০ জুলাই শনিবার বিকেল ৪টা নাগাদ মামার বাসা থেকে বের হয়ে আশুলিয়ার জিরানির নিজের বাসার উদ্দেশে রওনা হন শুভ। পথিমধ্যে সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের মধ্যে আটকা পড়েন তিনি।

সাধনা শীল বলেন, ‘রাস্তায় গাড়ি না চলার কারণে ভেঙে ভেঙে অনেক কষ্টে রাত ৮টা নাগাদ আমরা হাসপাতালে পৌঁছাই। সেখানে যাওয়ার পর ছেলের জন্য রক্ত জোগাড় করি অনেক কষ্টে। কারণ কেউ সে সময় এই পরিস্থিতির মধ্যে বের হতে পারছিল না, দেশে কারফিউ। একদিকে রক্ত দেয়, আরেকদিক দিয়ে বের হয়ে যায়। সেদিন রাতে শুভকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার পর সেখান থেকে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। অপারেশনের পর আর আমার মানিক কথা বলেনি। ছেলেকে বাঁচাতে ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা ধার করতে হয়েছে। ভাইয়ের স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে এক লাখ টাকা নিয়েছি। এনাম মেডিকেল হাসপাতালে দুই লাখ টাকা বিল নিয়েছে। আমরা ৯০ হাজার টাকার ওষুধ কিনে দিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘ঝিনাইদহের মুনুড়িয়া গ্রামে একটু ভিটামাটি ছাড়া আর কোনো সম্পদ নাই আমাদের। আশুলিয়ার জিরানি এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকি সবাই। দুই ছেলে আর আমি নিজেও গার্মেন্টসে চাকরি করি, আশা ছিল সবার আয়ে টাকা জমায়ে বাড়িতে একটা ঘর দিব। আমার পুরো সংসারটা এলোমেলো করে দিল তারা।’

শুভর মামা বাসুদেব বিশ্বাস বলেন, ‘গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) বিকেল থেকে শুভ আমার বাড়িতে। পরদিন বিকেল আনুমানিক ৪টায় বাসায় যাওয়ার জন্য বের হয় সে। আমাদের এখান (চৌঠাইল) থেকে তো সাভার নামাবাজার হয়েই যাতায়াত করতে হয়। এরপরই এই ঘটনা।’

ঝিনাইদহের ঘোড়শাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদ পারভেজ লিল্টন বলেন, মুনুড়িয়া গ্রামের শুভ সাভারের ঢাকায় গুলিতে নিহত হন বলে তার পরিবারের কাছ থেকে জানতে পারি। তবে লাশ গ্রামের বাড়িতে আনার কোনো পরিবেশ ছিল না। সাভারেই দাহ করা হয়েছে বলে শুনেছি। সূত্র: কালবেলা

দেশ জার্নাল বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো মন্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো।

----- সংশ্লিষ্ট সংবাদ -----